
এরা যখন কোনো মুসলিম ভাই বা বোনকে দেখে, যারা তাদের মতো চিপা, খোলা জামা পরে ‘জীবনটা উপভোগ’ করে না, ভিডিও গেম, হিন্দি সিরিয়াল, মুভিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বুঁদ হয়ে থাকে না, রেস্টুরেন্টে গিয়ে বাবা-মার কষ্টের অর্জন মুহূর্তের মধ্যে উড়িয়ে দিয়ে আসে না — তখন ভাবে, “ইস! জীবনটা কীভাবে এরা নষ্ট কর্তেসে? মোল্লাগুলো এদের ব্রেইন এমন ওয়াশ করে দিসে! মাথা এক্কেবারে গেসে। এরা কী আনস্মার্ট, ব্যাকডেটেড! হাজার বছর আগের গেঁয়ো আরবদের মতো লাইফস্টাইল এখনো এরা ফলো কর্তেসে।”—
যারা জেনেশুনে সত্য অস্বীকার করে, তাদের জন্যই এই দুনিয়াটাকে বিশেষভাবে আকর্ষণীয় করে সাজানো হয়েছে। বিশ্বাসীদেরকে এরা উপহাস করে। কিন্তু যারা আল্লাহর প্রতি সবসময় সাবধান থাকে, কিয়ামতের দিন তারা ওদের উপরে থাকবে —আল্লাহ যাকে চান তাকে এমন সামর্থ্য-সংস্থান দান করেন, যার কোনো হিসাবই হয় না। [আল-বাক্বারাহ ২১২]
কিন্তু এরপরেও কিছু মানুষ আছেন যারা সমাজ, সংস্কৃতি, সম্মান, সম্পদ, ক্ষমতা, স্ট্যাটাস, ‘লোকে কী বলবে’ এসবের থেকে আল্লাহকে ﷻ বেশি ভালবাসতে পেরেছেন। তাদের কথার ধরণ, পোশাকের ধরণ, বন্ধু-বান্ধবদের প্রকৃতি, ঘরের আসবাবপত্র, লাইব্রেরিতে সাজিয়ে রাখা বইগুলো, ফেইসবুকের স্ট্যাটাস, মোবাইল ফোনের অ্যাপসগুলো—এই সবকিছু দেখলে বোঝা যায় যে: এদের জীবনে কোনো একটা বিরাট উদ্দেশ্য আছে এবং এরা সেই ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস। এরা শপিং মলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেহুদা ঘুরে বেড়ান না, প্রতিদিন ফোনে দুই ঘণ্টা গল্প করেন না, দিনে তিনটা হিন্দি সিরিয়াল দেখেন না, ফেইসবুকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন না, রাস্তা ঘাটে বসে পুরো সময়টা মোবাইল ফোনে Angry Birds খেলেন না। এদের ভাবসাব পুরোই আলাদা। একদল মানুষ এদেরকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করে, এদেরকে নানা ধরনের নাম দেয়: মোল্লা, নিনজা, তালেবান, হুজুর। কিন্তু আল্লাহ ﷻ এদের সম্পর্কে বলেছেন—
কিন্তু যারা আল্লাহর প্রতি সবসময় সাবধান থাকে, কিয়ামতের দিন তারা ওদের উপরে থাকবে —আল্লাহ যাকে চান তাকে এমন সামর্থ্য-সংস্থান দান করেন, যার কোনো হিসাবই হয় না।
কিয়ামতের দিন এই সম্মানিত মুসলিমরা থাকবেন অনেক উপরে। তাদেরকে আল্লাহ ﷻ এত দেবেন যে, তারা হিসেব করে কুলাতে পারবে না: কীভাবে তারা এত কিছু পেলো? একসময় জান্নাতে গিয়ে তাদের মনে পড়বে ওই সব বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশীদের কথা, যারা তাদেরকে উপহাস করতো, হুজুর ডাকতো, নানাভাবে অপমান করতো। তখন তারা খোঁজ খবর নেবেন ওদের কী অবস্থা—
জান্নাতে তারা একে অপরকে অপরাধীদের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে। তারা জাহান্নামিদেরকে ডাক দেবে, “তোমরা জাহান্নামে গেলে কীভাবে?” জাহান্নামিরা বলবে, “আমরা নামাজ পড়তাম না। আমরা গরিবদের খাওয়াতাম না। একসাথে বসে ঠাট্টা, উপহাস, ফালতু কথা বলতাম। আমরা বিচার দিনকে অস্বীকার করতাম, যতক্ষণ না আমাদের সামনে তা স্পষ্ট হয়ে গেল।” [আল-মুদ্দাছ্ছির ৭৪:৪০-৪৭]
আমরা জীবনে প্রায়ই এমন কিছু পরিস্থিতিতে পড়ি, যখন ইসলামের নিয়ম মেনে চললে, আল্লাহর ﷻ নির্দেশ অক্ষরে-অক্ষরে পালন করলে দেখা যাবে যে, আত্মীয়-বন্ধুদের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটবে, ব্যবসায় কোনো বড় কাস্টমার হারিয়ে ফেলব, চাকরিতে প্রমোশন হাতছাড়া হয়ে যাবে, সমাজে স্ট্যাটাস নষ্ট হয়ে যাবে, লোকজন নানা কথা বলাবলি করবে ইত্যাদি। জীবনে প্রায়ই এমন ঘটনা আসে, যখন নিজেকে বোঝাতে হয়, “থাক না, একদিনেরই তো ব্যাপার। একটু ঘুষ খেলে কী হয়। সবাই খাচ্ছে না?” অথবা হয়তো নিজেকে যুক্তি দেখাই, “আমি যদি এটা না করি, তাতে কী হবে? আমার পরে যে আসবে সে তো ঠিকই করবে। তারচেয়ে এবার একটু অন্যায় করি। পরে বেশি করে ভালো কাজ করে পাপ কেটে নেবো।”
স্ট্যাটাস, সম্পত্তি, ক্ষমতা, সম্মানকে আমরা এতটাই ভালবাসি যে, এদেরকে ধরে রাখার জন্য মাঝে মাঝেই ইসলামকে বিসর্জন দিয়ে দেই। জেনেশুনে আল্লাহর ﷻ নির্দেশ অমান্য করি। মনে মনে আল্লাহর ﷻ সাথে পাপ-পুণ্যের লেনদেনের হিসেব করি। তাঁকে ﷻ বোঝানোর চেষ্টা করি: কেন তাঁর ﷻ নিষেধ এবার মানছি না, এবং কেন তাঁর ﷻ উচিত এবার আমাকে মাফ করে, আরেকবার সুযোগ দেওয়া।
যারা জেনেশুনে সত্য অস্বীকার করে, তাদের জন্যই এই দুনিয়াটাকে বিশেষভাবে আকর্ষণীয় করে সাজানো হয়েছে
আজকাল অনেক ‘আধুনিক মুসলিম’ কু’রআনের আয়াতগুলোর পরিষ্কার বাণীকে ধামাচাপা দিয়ে, অনেকসময় বিশেষভাবে অনুবাদ করে, ইসলামকে একটি ‘সহজ জীবন ব্যবস্থা’ হিসেবে মানুষের কাছে প্রচার করার চেষ্টা করছেন। তারা দেখছেন যে, পাশ্চাত্যের ‘উন্নত’ জাতিগুলো ধর্ম থেকে দূরে সরে গিয়ে কত আনন্দের জীবন যাপন করছে, জীবনে কত স্বাধীনতা উপভোগ করছে: প্রতিদিন রং-বেরঙের মদ পান করছে, বিশাল সব আভিজাত্যের হোটেলে গিয়ে জুয়া খেলছে, সুইমিং পুলে সাঁতার কাটছে; ইচ্ছামত কাপড় পড়ছে, বন্ধু বান্ধব নিয়ে নাচগান করছে—জীবনে কতই না ফুর্তি ওদের।
ওদের এত সুখ, এত আনন্দ দেখে তারা ভিতরে ভিতরে ঈর্ষায় জ্বলে যাচ্ছে। কেন তারা ওদের মতো ফুর্তি করতে পারবে না? কেন তাদেরকে এতটা নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করতে হবে?— এটা তারা কোনোভাবেই নিজেদেরকে বোঝাতে না পেরে, চেষ্টা করছে কোনোভাবে যদি ইসলামকে একটি ‘আধুনিক’, ‘সহজ’ জীবনব্যবস্থা হিসেবে মানুষের কাছে প্রচার করা যায়। তখন তারা পশ্চিমাদের মতো ফুর্তি করতে পারবে, আবার মুসলিমদের কাছ থেকে একদম দূরেও সরে যেতে হবে না, সমাজে অপরাধীর মতো লুকিয়ে চলতে হবে না। ‘মুহাম্মাদ’ ‘আব্দুল্লাহ’ নাম নিয়ে একদিকে তারা সপ্তাহে একদিন জুম্মার নামাজ পড়তে যেতে পারবে, অন্যদিকে বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে মেয়েদের সাথে নাচতে পারবে, থার্সডে নাইট পার্টিতে বন্ধুদের সাথে একটু রঙিন পানিও টানতে পারবে। এভাবে তারা ‘আল্লাহ যা পাঠিয়েছেন সেটা গোপন রাখে, আর দুনিয়ায় সামান্য লাভের বিনিময়ে তা বেচে দেয়,’—কু’রআনের শিক্ষার পরিপন্থী একটি জীবনযাত্রাকে নিজেদের ফুর্তির জন্য মুসলিমদের কাছে গ্রহণযোগ্য করানোর চেষ্টা করছে।
অথচ তারা একটু চিন্তা করলেই দেখতে পেত যে, এইসব চাকচিক্য, আমোদ-ফুর্তির পরিণতি হলো ডিপ্রেশন, অপুষ্টি জনিত শারীরিক সমস্যা, পরকীয়া থেকে মানসিক অশান্তি, তালাক, অ্যালকোহল জনিত অসুস্থতা, মারামারি, খুনাখুনি, ছেলেমেয়েদের ইয়াবা আসক্তি, নানা ধরনের যৌন অসুখ থেকে শেষ পর্যন্ত এইডস। দুনিয়ার কোনো হারাম আনন্দ মানুষকে কখনই সুখী করতে পারে না। কিছু সময়ের জন্য মানুষ হয়তো আমোদ-ফুর্তি করে, কিন্তু তারপরেই শুরু হয় জীবনে নানা সমস্যা এবং অসুখ। আসলেই, ‘ওরা নিজেদের পেটে জাহান্নামের আগুন ছাড়া আর কিছু ভরে না।’
আল্লাহ যা পাঠিয়েছেন সেটা যারা গোপন রাখে, আর দুনিয়ায় সামান্য লাভের বিনিময়ে তা বেচে দেয়, ওরা নিজেদের পেটে জাহান্নামের আগুন ছাড়া আর কিছু ভরে না। কিয়ামতের দিন আল্লাহ ওদের সাথে কথা বলবেন না, ওদেরকে পবিত্রও করবেন না। ওদের জন্য রয়েছে প্রচণ্ড কষ্টের শাস্তি। [আল-বাক্বারাহ ১৭৪]
মানুষের জন্য যা কিছুই সত্যিকারের ভালো, যা কিছুই কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়া নির্মল আনন্দের—সেটা আল্লাহ ﷻ ইতিমধ্যেই হালাল করে দিয়েছেন। তিনি যা কিছুই হারাম করেছেন, তার প্রত্যেকটির পিছনেই কোনো না কোনো বিরাট ক্ষতি রয়েছে। একটু সময় নিয়ে চিন্তা করলে, পরিসংখ্যানগুলো দেখলেই বোঝা যায় যে, আল্লাহ ﷻ সেগুলোকে হারাম করে দিয়ে আমাদের কত বড় উপকার করেছেন।
যখন কোনো মুসলিম নিজের কামনা বাসনাগুলো পূরণ করা এবং জীবন উপভোগ করাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য বানিয়ে ফেলে, তখন সে সত্য এবং বাস্তবতাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে। সে তখন তার যা-ই সামর্থ্য আছে, তার সব ব্যবহার করে দুনিয়াকে পাওয়ার জন্য, সেটা ইসলামকে বিক্রি করে দিয়ে হলেও। এরা তখন ইসলামের অপব্যাখ্যা করে নিজের দুই নম্বর অর্জন, লাইফস্টাইলকে সঠিক বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করে। এরা ধর্ম ব্যবহার করে উপরের লেভেলের মানুষদেরকে হাত করার জন্য, যেন তাদের কাছ থেকে সম্পত্তি, ক্ষমতা প্রতিপত্তি হাতিয়ে নিতে পারে। কুফরি অর্থ শুধু অবিশ্বাস নয়, এর অর্থ হলো জেনেশুনে সত্যকে অস্বীকার করা, সত্যকে ধামাচাপা দেওয়া। টুপি, দাঁড়ি, পাঞ্জাবি পরে, মাওলানা-মুফতি উপাধি নিয়েও মানুষ কুফরি করতে পারে, যখন তার জীবনের উদ্দেশ্য থাকে নিজের চাওয়া-পাওয়াগুলোকে যেভাবেই হোক পূরণ করা। ধর্ম তখন তার একটি হাতিয়ার মাত্র। এই ধরনের মানুষরা ভয়ঙ্কর। এরা একজোট হয়ে সরকারকে হাতিয়ে নিয়ে, দেশের মানুষ যেন ইসলামের সঠিক শিক্ষা কখনো পেতে না পারে, তার ব্যবস্থা করে দিতে পারে।
বিশ্বাসীদেরকে এরা উপহাস করে
দুঃখজনকভাবে, আজকাল ‘মুসলিমদের’ মধ্যে একটা ধারণা জন্মে গেছে যে, আমরা যদি সপ্তাহে একদিন মসজিদে হাজিরা দেই, রমজানে ত্রিশ দিন না খেয়ে থেকে হিন্দি সিরিয়াল, মুভি দেখি, দশ বছরে এক-দুইবার গরিবদের কিছু টাকা দিয়ে আসি —তাহলে আমাদের জন্য জান্নাতের গ্যারান্টি দেওয়া আছে। এর বেশি কিছু করার কোনোই দরকার নেই। এর বেশি যাকে করতে দেখি, তাকেই আমরা বাড়াবাড়ি করছে বলে মনে করি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে গিয়ে পড়াটা আমাদের কাছে একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার। দাঁড়ি রাখা, ঠিকমতো হিজাব করাটা তালেবান হয়ে যাওয়ার লক্ষণ। সিরিয়াল দেখা বন্ধ করা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারা ছেড়ে দেওয়া, সিনেমা হলে মুভি দেখতে না যাওয়া, দিনে ৪-৫ ঘণ্টা ভিডিও গেম না খেলা —এগুলো হচ্ছে ‘জিহাদি’ হয়ে যাওয়ার লক্ষণ। কোনো এক অদ্ভুত কারণে দিনে দিনে মুসলিমদের স্ট্যান্ডার্ড নামতে নামতে এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, আজকাল আম-জনতা মুসলিমদেরকে দেখে ঠিক বোঝা যায় না তারা আসলে কোন ধর্ম অনুসরণ করছে। তারা যে ধর্ম অনুসরণ করছে সেটা অন্তত কু’রআনে বলা নেই। কে এই ধর্ম প্রচার করেছে, সেটা বড়ই আশ্চর্যের ব্যাপার!
0 comments:
Post a Comment